
*ঢাকা, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর*
গতকাল রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সৌদি আরব থেকে অবৈধভাবে বা অনৈতিক পন্থায় আটক করে ফেরত পাঠানো ১১০ জন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক দুইটি ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসেন। সৌদি এয়ারলাইন্সের SV 803 এবং SV 804 ফ্লাইটে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।
ফ্লাইট দুটি যথাক্রমে রাত সাড়ে বারোটা এবং রাত ১:৩৫ মিনিটে অবতরণ করে। দেশে ফেরা এই মানুষগুলোর কষ্টের কথা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কারো গায়ে জামা নেই, কেউ চোখে পানি মুছছে, কেউবা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যে জমে আছে অসহনীয় বেদনার পাহাড়।
ঝটিকা অভিযানে আটকের নির্মম বাস্তবতা
সৌদি আরবে বর্তমানে এক ধরনের ঝটিকা অভিযান চলছে। বাংলাদেশী, ভারতীয়, পাকিস্তানি সহ অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোর শ্রমিকদের উপর চিরুনি অভিযান চালানো হচ্ছে।
অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক অভিযোগ করেছেন, তারা বৈধ আকামা (বাসস্থান অনুমতি) থাকা সত্ত্বেও নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার সময় বা জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হলে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেছে।
সৌদি আরবে পুলিশ কোনও যাচাই-বাছাই না করেই শ্রমিকদের ধরে নিয়ে জেলে পাঠাচ্ছে। সেখানে মাসের পর মাস আটকে রাখার পর তাদের কাগজপত্র বাতিল দেখিয়ে জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
বৈধতার প্রশ্ন ও আকামা:
অনেকেই জানিয়েছেন, তাদের আকামা বৈধ ছিল। তবে সৌদি আরবে চাকরি পরিবর্তন বা স্পন্সর পরিবর্তনের সময় মালিক পক্ষের অনিচ্ছা বা প্রশাসনিক জটিলতার কারণে অনেকে আকামার নবায়ন করতে পারেননি। এর ফলে তারা ‘অবৈধ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, অথচ প্রকৃতপক্ষে এর জন্য তারা দায়ী ছিলেন না।
বেশ কিছু শ্রমিক বলেছেন, তাঁরা সৌদি আরবে নিজেদের রুজি-রোজগারের জন্য ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। মালিক বা কোম্পানির সাথে আর্থিক দ্বন্দ্বের কারণে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
অনেক শ্রমিকের অভিযোগ, সৌদি জেলখানায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে।
– প্রায় ২-৩ মাস বন্দী ছিলেন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
– চিকিৎসা সুবিধা ছিল না।
– খাবার ছিল অপ্রতুল এবং নিম্নমানের।
– পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
– মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
একজন ফেরত আসা শ্রমিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,
_”আমি পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি গিয়েছিলাম। এখন সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরে আসলাম। আমার পরিবারের এখন না আছে খাবার, না আছে মাথার ওপর ছাদ।”_
৪০০০-এর অধিক শ্রমিক এখনো মানবেতর অবস্থায়
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে সৌদি আরবে আরও অন্তত ৪০০০-এর বেশি বাংলাদেশি নাগরিক জেলখানায় আটক আছেন। অনেকে আকামা নবায়ন করতে না পারায়, বা ভিসার সমস্যা থাকায়, অথবা মালিক পক্ষের অমানবিক আচরণের কারণে আটকা পড়ে আছেন।
অনেকের আকামা মালিকপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে বাতিল করে দিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো নিজেদের দায়মুক্তির জন্য শ্রমিকদের অবহেলিত রেখেছে।
প্রবাসীদের আকুল আবেদন ও ড. ইউনুসের প্রতি আস্থা.
ফেরত আসা বাংলাদেশিরা আজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে অনুরোধ জানিয়েছেন,
– সরকার যেন সৌদি আরব সরকারের সাথে অবিলম্বে কূটনৈতিক আলোচনায় বসে।
– আটক থাকা শ্রমিকদের দ্রুত মুক্তির জন্য ব্যবস্থা নেয়।
– ফেরত আসা শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
– সৌদি আরবের শ্রমনীতি সহজীকরণের জন্য নতুন চুক্তি করা হয়।
তারা Nobel Laureate ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মানবাধিকার বিষয়ক অবদান স্মরণ করে তাকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তিনি এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
*বাংলাদেশ সরকারের করণীয়:*
– দ্রুত সৌদি আরব সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা।
– সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমিক কল্যাণ অফিসগুলোকে আরও সক্রিয় ও মানবিক করা।
– যারা অবৈধভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ ও আইনি সহায়তা প্রদান।
– প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে আলাদা সেল গঠন।
– ফেরত আসা শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প চালু।
*সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো: মানবিক সংকট ও করণীয়*
সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর ঘটনা একটি গভীর মানবিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতি শ্রমিকদের জীবনে যে প্রভাব ফেলেছে, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক দিক থেকেও গভীর।
*শ্রমিকদের ফেরত আসার পেছনের কারণসমূহ*
সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে:
1. *ইকামা নবায়নে জটিলতা*: অনেক শ্রমিকের ইকামা (বসবাসের অনুমতি) নবায়ন না হওয়ায় তারা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য হন। অনেক সময় নিয়োগকর্তারা ইকামা নবায়নের দায়িত্ব পালন করেন না, ফলে শ্রমিকরা সমস্যায় পড়েন।
2. *কাজের ক্ষেত্র সঙ্কুচিতকরণ*: সৌদি সরকার ১২ ধরনের কাজ শুধুমাত্র সৌদি নাগরিকদের জন্য নির্ধারণ করেছে, যার ফলে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
3. *নিয়োগকর্তার দ্বারা প্রতারণা*: কিছু নিয়োগকর্তা শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করে, যেমন বেতন না দেওয়া বা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করা।
*ফেরত আসা শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা*
ফেরত আসা শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত করুণ:
– *আর্থিক ক্ষতি*: অনেক শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার জন্য ঋণ নিয়ে থাকেন। কাজ না পেয়ে বা বেতন না পেয়ে তারা ঋণ শোধ করতে পারেন না।
– *মানসিক চাপ*: অবৈধভাবে আটক হওয়া, নির্যাতন, এবং দেশে ফেরার পর সামাজিক লজ্জা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়।
– *পরিবারের উপর প্রভাব*: আর্থিক অনিশ্চয়তা পরিবারে চাপ সৃষ্টি করে, অনেক সময় পরিবার ভেঙে যায়।
*সরকারি সহায়তা ও পদক্ষেপ* বাংলাদেশ সরকার কিছু সহায়তা প্রদান করেছে:
– *বীমা সুবিধা*: বিদেশে গিয়ে ছয় মাসের মধ্যে কাজ না পেয়ে ফেরত আসা শ্রমিকদের জন্য ৫০ হাজার টাকা বীমা সুবিধা চালু করা হয়েছে। [3]
– *পুনর্বাসন উদ্যোগ*: ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়।
*মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ*
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সৌদি আরবে শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে:
– *অমানবিক আচরণ*: শ্রমিকদের আটক কেন্দ্রে অমানবিক পরিবেশে রাখা হয়, যেখানে খাবার ও চিকিৎসার অভাব রয়েছে। [1]
– *নির্যাতন ও শোষণ*: শ্রমিকরা নির্যাতন ও শোষণের শিকার হন, এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
*সমাধানের পথ*
এই সংকট মোকাবেলায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
1. *দ্বিপাক্ষিক চুক্তি*: বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী চুক্তি করা।
2. *দূতাবাসের কার্যকর ভূমিকা*: বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে শ্রমিকদের সহায়তায় আরও সক্রিয় করা।
3. *প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা*: বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা প্রদান।
4. *আইনি সহায়তা*: প্রতারিত শ্রমিকদের জন্য আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা।
সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর ঘটনা একটি জটিল মানবিক ও সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানে সরকার, মানবাধিকার সংস্থা, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
আজকের এই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে। দেশের রেমিট্যান্সের বড় একটা অংশ আসে এই পরিশ্রমী মানুষগুলোর হাত ধরে। অথচ আজ তারা অন্যায়ভাবে হয়রানি এবং দুর্দশার শিকার।
তাদের জীবনসংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে এখনই দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। প্রতিটি প্রবাসীর কান্না যেন সরকারের কর্ণগোচর হয়—এটাই আজকের দিনটির মূল বার্তা।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও উন্নয়নের স্বার্থে, এইসব পরিশ্রমী, নিষ্পেষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি।
#সৌদি_ফেরত_বাংলাদেশি #মানবাধিকার_লঙ্ঘন #প্রবাসী_শ্রমিক_সঙ্কট #বাংলাদেশ_সরকার #কূটনৈতিক_উদ্যোগ #শ্রমিক_পুনর্বাসন #ডক্টর_ইউনুস #সৌদি_জেলখানা #প্রবাসী_সমস্যা #শ্রমিক_অধিকার।