• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুড়াপাড়ার সাড়ে ৫‘শ বছরের পুরনো শাহী মসজিদ

জয়নাল আবেদীন জয়
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১, ২১:০৫ অপরাহ্ণ
মুড়াপাড়ার সাড়ে ৫‘শ বছরের পুরনো শাহী মসজিদ

কারুকার্য ও নির্মাণশৈলী বিবেচনায় স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন শাহী মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এ শাহি মসজিদ। প্রায় সাড়ে পাচ’শ বছরের পুরনো এই মসজিদটির স্থাপত্যরীতিতে মোগল ভাবধারার ছাপও সুস্পষ্ট। অবস্থান রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজার ঘেষা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। এ মসজিদ নিয়ে রয়েছে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী। রয়েছে নানা ইতিহাস। বিভিন্ন ইতিহাস ও বইপত্র ঘেটে জানা যায়, ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের ইলিয়াস শাহি বংশের উত্তরাধিকার নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ছেলে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ আছিয়া খাতুনের পরগনা শীতলক্ষ্যা তীরের মুড়াপাড়া এলাকায় আসেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দীন, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী, মনসুর সিরাজী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসু। তিনি কয়েক মাস এ পরগনায় থেকে ঘুরে ঘুরে এলাকা দেখেন। আছিয়া খাতুনের আতিথেয়তাও তাকে মুগ্ধ করে। তিনি এলাকাটি দেখে খুবই পছন্দ করেন। পরে তিনি এ পরগনায় মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরপর আছিয়া খাতুনের সঙ্গে আলোচনা করে মসজিদের কাজ শুরু করেন। মসজিদটি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন ঐ সময়কার তার পৃষ্ঠপোষক মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দিন, আমীর শিহাবউদ্দিন কিরমানী ও মনসুর সিরাজী। একপর্যায়ে জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে নিয়ে বরবক শাহ তার রাজ্য গৌড়ে ফিরে যান। এরপর ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরবক শাহ পরলোক গমন করেন। পরে জৌনপুরের মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুর মুখে তার পিতার মসজিদের অসমাপ্ত কাজের বর্ণণা শুনে তিনি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করার তাগিদ দেন বরবক শাহের পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ। ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ শাহ দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে সঙ্গে নিয়ে আছিয়া খাতুনের পরগনায় আসেন। এসময় তিনি পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহী মসজিদ। একপর্যায়ে পরগনার ১৮ বিঘা জমি মসজিদের নামে দিয়ে দেওয়া হয়। এসময় মসজিদের দায়িত্বভার আমীর জয়েনউদ্দিন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দিন ও মনসুর সিরাজীকে বুঝিয়ে দিয়ে ইউসুফ শাহ পৃষ্ঠপোষক বাসুদেব বসুকে নিয়ে তার রাজ্য উড়িষ্যায় ফিরে যান। বরবক শাহ’র আমলে চট্রগ্রাম ও পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জেও দুটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
জানা যায়, শাহী মসজিদের পাশে রয়েছে ৫ টি কবর। এলাকার বর্ষীয়ান মুরুব্বিদের মতে, এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পরগনার মালিক আছিয়া খাতুন, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দিন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দিন ও মনসুর সিরাজী। আরেকজন শমসের মিয়া নামে এক পথচারী। জানা যায়, মোগল আমলের পতনের পরে ১৮৮৬ সালে ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জমিদার জগদীশচন্দ্র বসু মসজিদটি মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলেন। পরে এর পাশেই জমিদাররা হিন্দুদের কালীমন্দির তৈরি করেন, যেটি এখনো বিদ্যামান। একপর্যায়ে মসজিদটি জঙ্গল দিয়ে ঢেকে যায়। এর চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
১৯২৫ সালে আট ফুট উচ্চতা সম্পন্ন শমসের মিয়া নামে এক লোক কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে যাবার সময় সুমধুর কন্ঠে কোরআন তেলওয়াত ও আজানের গায়েবী ধ্বনি শুনতে পেয়ে থমকে দাড়ান। এনিয়ে তার কৌতুহলও বেড়ে যায়। পরেরদিন থেকেই তিনি অদাতাঞ্চলের মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘটনা জানান এবং জঙ্গল পরিস্কার করে দেখার কৌতুহল প্রকাশ করেন। কিন্ত সে আমলে তখন জমিদারদের ভয়ে অনেকে জুবুথুবু হয়ে থাকতো। সে কারনে তার আহবানে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেলো না। কদিন পা তিনি একাই জঙ্গল পরিষ্কার করে ও মাটি খোদাই শুরু করে। পরে আছরের ওয়াক্ত মসজিদের গম্বুজ আবিস্কার করেন। ততোক্ষনে জমিদারের কানে পৌছে গেছে জঙ্গল পরিস্কার করার সংবাদ। এদিকে সমসের মিয়া গম্বুজ পরিষ্কার করে মিনারে দাড়িয়ে আজান দেয়ার সময় জমিদারদের নির্দেশে তাদের পাইক-পেয়াদা তাকে গুলি করে। পরে শমসের মিয়াকে মুসলমান তিন সাহিত্যিকের পাশেই দাফন করা হয়। এনিয়ে কলকাতা আদালতে শমসের মিয়ার মা জমিলা খাতুন মামলাও দায়ের করেন। নবাব স্যার সলিমুল্লার আদালতে বিচারের রায় দেওয়া হয়। রায় শমসের মিয়ার পক্ষে যায়। মুড়াপাড়া এলাকার অন্যতম প্রয়াত চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ ডাঃ আব্দুল জলিলের হাতে লেখা পান্ডুলিপিতে এসব ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে।
জানা যায়, বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৪০ ফুট করে। চাপরপাশের দেয়াল ছয় ফুট আট ইঞ্চি চওড়া। পূর্বপাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। এই ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি একেবারেই আলাদা। মসজিদের গম্বুজ খাজকাটা। গম্বুজের চূড়া গোলাকার ও সুচালো। খিলানের চারপাশ লতাপাতার কারুকাজ। ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসাবে টিকে থাকা এই শৈল্পিক স্থাপনার শরীরজুড়ে এখন শুধুই অযতœ আর অবহেলার ছাপ। তবে এ পর্যন্ত প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কারো পা পড়েনি এই স্থাপনায়। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন মিয়া বলেন, দুরদুড়ান্তের লোক আসে মসজিদে নামাজ আদায় করতে। শুক্রবারে অনেক ভীড় হয়। এই মসজিদে নামাজ যারা পড়েন সবাই স্বীকার করেছে দেহমন তাদের প্রশান্তিতে ভরে উঠে। বাপ-দাদাগো মুখে হুনছি এই মসজিদের বয়স সাড়ে ৫’শ বছরের মতো।