• ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পূর্বাচলে কীটনাশকবিহীন সবজি চাষ

জয়নাল আবেদীন জয়
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১, ২১:১৪ অপরাহ্ণ
পূর্বাচলে কীটনাশকবিহীন সবজি চাষ

যেদিকে চোখ যায়,শুধু সবজি আর সবজি। চারদিক যেন সবুজের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ সেখানকার চাষীরা এখন কীটনাশকবিহীন সবজি চাষ করছেন । রাধজানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ( রাজউক) এর অধিগ্রহন কৃত বিশাল এলাকাজুড়ে ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে সবজি চাষ করে স্থানীয় কৃষকরা ঘটিয়েছেন কৃষী বিপ্লব। উল্লেখিত এলাকার ৩০ গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করে তারা বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট। চলতি মৌসুমে প্রায় ১০ কোটি টাকার সবজি বিক্রি হবে ঢাকাসহ সারাদেশে। এখান থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সবজি চলতি মৌসুমে বিদেশ রফতানি হয়েছে, হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এ এলাকাগুলোকে মানুষ সবজির গ্রাম বলেই এখন চেনেন ।
সবজি চাষের এলাকা ঃ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ( রাজউক) আধুনিক শহর গড়ায় লক্ষ্যে নারায়নগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার রূপগঞ্জ সদর ও দাউদপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের সাড়ে ৪ হাজার একর জমি অধিগ্রহন করে ৯০ এর দশকে। সেসব জমিতে বালি ভরাট করা হলে বিশাল তেপান্তর মাঠে রুপ নেয় এলাকাগুলো। আদিবাসী কৃষকরা গত কয়েকবছর পূর্বে সেসব জমিতে সবজি চাষ শুরু করলে সত্যিই সোনা ফলাতে সক্ষম হয়। এখানকার ৩০টি গ্রামের কয়েকহাজার কৃষক পরিবার সবজি চাষ করে পাল্টে দিয়েছে এলাকার দৃশ্যপট। সবজি চাষ হচ্ছে আশেপাশের গ্রামগুলোতেও। সবজি চাষ করে এসব গ্রামের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। এলাকাগুলোর মধ্যে চাপরি, গোবিন্দপুর, কামতা, হারারবাড়ি, পরশি, কুমারটেক, বাতান, মাঝিপাড়া, কুচিলাগর ,সুলপিনা, আলমপুর, ,ইছাপুরা, বাড়িয়াছনি, গোয়ালপাড়া ,কালনি, জিন্দা, ধামচি, ভোলান, হিরনাল,গুতিয়াব, আগারপাড়া, বৈলদা, কুলপ, বিরহাটাবো, বাগলা, তীর মারা, আমদিয়া, রাতুরা, পলখান, পাঞ্জারা, বেলুন, গলান, আমারুন, কেতুুন, পারাবরতা, বরকাউ, কালিকুটিসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের হাজার হাাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী সবজির আবাদ করে এখন স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে। সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর চাষীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব এলাকায় কাকরোল, চিচিঙ্গা, করলা, বরবটি, শসা, কচু, ধুন্দুল, জিঙ্গা, বেগুন, লাউসহ কিটনাশকবিহীন বিভিন্ন সবজির চাষ হচ্ছে। রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের পরশী গ্রামের আলী হোসেন মাষ্টার শিক্ষকতার পাশা-পাশি নিড়ানি ও কাচি তুলে নিয়েছেন। তার কথা “এলাকার জমিতে সোনা ফলে। একটু পরিশ্রম করলেই কৃষি কাজেও ভাগ্য খুলে যায়”। এবার তিনি ৪ বিঘা জমিতে সবজি চাষ করছে। চলতি বছর ৫ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। অন্যদিকে চিনাল আর শসার আবাদ করে রূপগঞ্জের দাউদপুরের চাপরি, বাতান, কুচিলাগর, বৈলদা ও কুলপ এলাকার শত শত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি এখন স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে। শসা আর চিনাল চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই চাষীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। চলতি মৌসুমে এসব গ্রাম থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার শসা আর ২০ লাখ টাকার চিনাল রফতানি হবে বলে কৃষকরা আশা করছেন। প্রতিদিন বিকালে পাইকাররা এসব এলাকা থেকে শসা আর চিনাল সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। চাষী ওমেদ আলী,ফটিক সহ আরো অনেকেই জানান, শসা আর চিনাল উৎপাদন করে চাষীদের বিক্রির জন্য কোন চিন্তাই করতে হয় না। এসব সবজি বিক্রির জন্য পূর্বাচলের কালনী এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল পাইকারী বাজার। ভোররাত থেকে ৮ টা পর্যন্ত ট্রাকে ঢাকাসহ সারাদেশে চলে যায় এসব সবজি। তাছাড়া ফড়িয়ারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব মালামাল কিনে নিয়ে যায়। তারাই আবার পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। প্রতি গ্রামেই অসংখ্য ফড়িয়া রয়েছে। আছে পাইকারও। প্রতিদিন এখানে ১ হাজার মন শসা ও ৫ হাজার চিনাল বেচাকেনা হচ্ছে। দুপুরের পর থেকেই গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে এবং মহাসড়কে শসার হাট বসে। সন্ধ্যা নাগাদ বেচাকেনা শেষ হয়। প্রতিরাতেই ট্রাকযোগে শসা ঢাকা নেয়া হয় । চাপরি গ্রামের শসাচাষী শিরিষচন্দ্র জানান,শসা চাষ খুবই লাভজনক। চারহাজার টাকা খরচ করে ১ বিঘা জমিতে শসার আবাদ করলে প্রায় ৬০/৭০ হাজার টাকা আয় হয়। তার নিজের ২ বিঘা জমি রয়েছে। পুরো জমিতেই তিনি শসা চাষ করেন। একই গ্রামের কৃষক আব্দুর বারেক অন্যদের দেখাদেখি পূর্বাচলের জমিতে চিনাল আর শসার আবাদ করে স্বচ্ছল হয়েছেন। স্থানীয় সবজির পাইকার আনোয়ার আলী জানান, প্রতিদিন ২/৩ ট্রাকযোগে কম করে ৮শ থেকে ১ হাজার মণ শসা ঢাকায় চালান করা হচ্ছে । আর কুচিলায় যে প্রচুর কচু ফলে তা গ্রামের নাম দেখেই বোঝা যায় । গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ মান্নান ব্যাপারি জানালেন,বাপ দাদারে দেখছি কচু ফলাইতে তাই আমরাও করছি। এটি সিজনাল সবজি হলেও তা বর্তমানে সারাবছরই ফলছে। ১ বিঘা জমিতে প্রায় ৩ হাজার পিস কচু ফলে। কৃষক রমজান হোসেন বলেন, লাল মাটির কচু খাইতে স্বাদ আছে। আমগো বেচাও ভালাই অয়। দাউদপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম বেলুন। এ গ্রামটি বেগুন উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। বেগুন চাষ করে এ গ্রামের অনেক মানুষ এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। এ গ্রামের বেগুন মাখনের মতো মোলায়েম, প্রায় বিচিবিহীন আর মনোগ্রাহী গন্ধযুক্ত হওয়ায় ভোজন রসিকদের রসনাসিক্ত করতে জুড়ি নেই বলে সারা দেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ সুযোগ স্থানীয় চাষিরাও দেদার আবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষক রামকমল, আব্দুল কালাম ,গাজী আনোয়ার জানান, বেলে দো-আশ মাটিতে বেগুন ভাল হয়। তবে বেগুন চাষের জন্য গোবর, সার ও ছাইয়ের বিশেষ প্রয়োজন। বেগুন চাষী মতিউর রহমান জানান, প্রতি বিঘা জমিতে বেগুন চাস করলে তাদের ৫ হাজার টাকা করচ হয় আর বেগুন বিক্রি করলে ঐ জমি থেকে তারা পায় ২৫/৩০ হাজার টাকা। তবে আগামীতে পূর্বাচলে নির্মানের প্ল্যান দেয়া হলে তাদের চাষাবাদ শেষ হয়ে যাবে বলে আশংখা করেন তারা। বর্তমানে অনেককে প্লট বুঝিয়ে দেয়ায় তাদেরকে সবজিসহ টাকা পয়সা দিতে হচ্ছে বলে জানান কামতা গ্রামের মনিরুল মোল্লা।
রূপগঞ্জের সবজি রফতানি হয় বিদেশে ঃ বাংলাদেশের রফতানীযোগ্য শাকসবজি ও ফলমূলের ২৭ ভাগ শুধু যুক্তরাজ্যেই রফতানি হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর সবজি যায় বিদেশে। কিন্তু অধিকাংশ সবজি ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ফলে বিদেশে তার চাহিদা কম। কারন বিদেশে সবসময় চাই কীটনাশকবিহীন সবজি। যেহেতু রূপগঞ্জ ও দাউদপুর ইউনিয়নের ৩০ গ্রামে যে সবজি চাষ হয় তাতে সামান্যতম কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। ফরোমন ট্রাপ ব্যবহার করে এ এলাকার সবজি চাষ হয়। ফলে পোকামাকড়ের আক্রমন থেকে রেহাই পাওয়া যায় বলে কৃষকরা বলেন। রূপগঞ্জের সবজি এখন বিদেশ রফতানি হচ্ছে বলে জানান তারা। প্রতি সপ্তাহে রফতানিকারকরা সরাসরি মাঠ থেকে কীটনাশকবিহীন সবজি তুলে নিয়ে যান বলে জানান কালনী এলাকার পাইকার আক্তার হোসেন।
রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষী কর্মকর্তা ফাতেহা নুর বলেন,সত্যিই রূপগঞ্জ সবজির গ্রাম। সম্পূর্ন কীটনাশকবিহীন সবজি ফলে এ এলাকাগুলোতে। সরকারীভাবে সহযোগীতা পেলে তারা আরো ভালো করতো । তবে যেহেতু জমিগুলো অধিগ্রহনকৃত তাই পরামর্শ আর দেখভালের বাইরে আমরা কৃষকদের খুব বেশী সহায়তা করতে পারিনা।